Thursday 18 October 2018



বার্ধক্যজনিত সমস্যা ও তার প্রতিকার 
বয়স বাড়লেও সতেজ থাকুন
ডাঃ প্রদীপ কুমার দাস
সভাপতি, ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন, শ্রীরামপুর শাখা
বিশ্বনাথ দত্ত। ৭৫ ছুঁইছুঁই। সম্প্রতি পত্নী বিয়োগ হয়েছে। মন ভারাক্রান্ত থাকে। একমাত্র মেয়ে বিয়ের পর বিদেশে বসবাস করছে। একাকীত্বে ভুগছেন। দিনের বেলায় তবু সময় বেশ ভাল কেটে যায়। রাত হলে দুঃশ্চিন্তার আর শেষ থাকে না। ঘুম আসতে চায় না। টিভি দেখে সময় কাটাতে হয়। যদিও বা ঘুম হয় তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। সকালে ওঠে ঝিমুনী ভাব। এবস্থায় টয়লেটে গিয়ে পা পিছলে পড়ে কোমরের হাড় ভেঙ্গে শয্যাশায়ী।শ্রীমতী শিখা কোলে। বয়স ৬৫। দুই হাঁটুতে প্রচন্ড ব্যথা। হাঁটা চলা করতেই পারেন না। চিকিৎসকের পরামর্শমত হাঁটু বদলেছেন।কিন্ত সেরকম কোন উন্নতি হয় নি। বরং আরও জুবুথুবু হয়ে পড়েছেন।অন্যজনের সাহায্য ছাড়া এক পা-ও চলতে পারেন না।
সুমন মিত্র। বয়স ৭০। অবসর নিয়েছেন বছর দশেক হল। চাকুরীতে থাকাকালীন কিছুই বুঝতে পারেন নি। এখন হাঁটাচলা কিংবা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলে বুক ধড়পড়, মাথা ঘোরা, অবসন্ন লাগে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তিনি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। নিয়মিত ওষুধ না খেলে ব্রেন স্ট্রোক কিংবা হৃদরোগ দেখা দিতে পারে। তাই সারাক্ষণই তিনি দুশ্চিন্তায় কাটান। 
ওপরের চিত্রগুলো একটা একটা খন্ডিত চিত্র হলেও সবকটাই কিন্তু বার্ধক্যজনিত সমস্যা। বার্ধক্য জীবনের শেষ অধ্যায়ের স্বাভাবিক পালাবদল। সাধারণভাবে মানুষের বয়স ৪০ পার হলেই দেহের ক্ষয়ক্ষমতা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে ক্ষতিপূরণের অভাব না মেটালে দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্থায়ী পরিবর্তন চলে আসে। এই পরিবর্তনের নাম হল বার্ধক্য। ৬০ বা তার উর্দ্ধ বয়সের লোকেদের এদেশে প্রবীন হিসাবে ধরা হয়। তবে এদেশে ৬০ বছর আসার আগেই  নানা রকম কারণে অনেকেই বুড়িয়ে যান। এমন কিছু অসুখ বিসুখ আছে যেগুলো এই বার্ধক্য বয়সে দেহের মধ্যে বাসা বেধে সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। যেমন- উচ্চ রক্তচাপ,চোখের ছানি, হাড়ের ক্ষয় বা অস্টিওপোরোসিস,ফাইব্রোসাইটিস,মায়োসাইটিস,
নিউরাইটিস,গাউট, রিউম্যাটেড আথ্রাইটিস, অস্টিওআথ্রাইটিস, স্পন্ডালাইটিস ইত্যাদি।

হাড়ের ক্ষয় রোগে তীব্র ব্যথা, বেঁকে যাওয়া ও সামান্য আঘাতে হাড় ভেঙে যায়, এমনকি পঙ্গু করে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। বলা যায় ক্ষয়রোগ হল একটা নীরব ঘাতক। উচ্চরক্তচাপও নীরব ঘাতকের কাজ করে। অনেক সময় বোঝায় যায় না যে রক্তের চাপ বিপজ্জনক ভাবে বেড়ে রয়েছে। হঠাৎ করে জ্ঞান হারানো ও পেশির পক্ষাঘাত, ব্রেন স্ট্রোক এর ঘটনা মনে করে দেয় উচ্চরক্তচাপের জন্যে ওইসব লক্ষণগুলো দেখা দিয়েছে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু মানসিক আচার-আচরণেরও বৈষম্য দেখা যায়। স্মৃতিশক্তি কমে আসা, অবমনীয় কঠোর মনোভাব দেখা দেয়, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে সায় না দেওয়া, অকারণে উত্তেজিত হওয়া, কিংবা কথায় কথায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়া জাতীয় মনস্তাত্বিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েন বয়স্করা। অবসর গ্রহণের পরে কাজ আরো কমে যাওয়ায় প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার মান বেশ খানিকটা পড়ে যায়। সেই কারণে মানসিক ও সামাজিক ভাবে সমস্যাগুলো মনের মধ্যে বেশ চাপের সৃষ্টি করে। সেই চাপ থেকে সহজে তাঁরা বেরিয়ে আসতে পারেন না।
বেশি বয়সে ঘুমের ঘাটতি আর এক বড় সমস্যা। গবেষকরা দেখেছেন, রাতে বয়স্কদের ঘুম না হওয়ার কারণ হল বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মগজের কোষগুলো কমে যেতে থাকে। মগজের কোষ ঘুমের সমস্যার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে নিবিষ্ট। কোষ কমে যাওয়ার জন্য ঘুমও যায় কমে। কম ঘুম হওয়ার জন্যে দিনেতে ঢুলুঢুলু ভাব হয়। কাজে মন লাগে না। কোন কাজই ঠিকমত শেষ করতে পারেন না। নিজেকে তখন খুব অসহায় ও বিহ্বল বোধ করেন। আর এই ঘুম ঠিকমত না হওযার ফলো হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, উচ্চরক্তচাপ একে একে ছেকে ধরে। অনেকে ঘুম না আসার জন্যে টিভি খুলে বসেন, রেডিও  শোনেন অনেক রাত অবধি। এগুলো গোদের উপর বিষফোঁড়া। ঘুমের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ে
বার্ধক্য বয়সের আর এক রোগ হল আলজাইমার বা ভুলো মনের রোগ। এ এক অদ্ভুত রোগ যা ভুলিয়ে দেয় চারপাশ, পরিবেশ এর কথা স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক গবেষণায় এটা লক্ষ্য করা গেছে, যে বার্ধক্য বয়সে এরোগ দেখা দিলেও এর সূত্রপাত হয় বহু আগে থেকেই
বার্ধক্য বয়সের আর এক সমস্যার রোগ হল পারকিনসনস রোগ। এরোগে হাঁটা চলার গতি কমে যায়। কোন কাজ করতে গেলে হাত-পা কাঁপতে থাকে। কথাবার্তায় জড়তা, পেচ্ছাব-পায়খানায় নিয়ন্ত্রণহীনতা। যৌন দুর্বলতা, ওটা-বসা ঘোরাফেরা সহ সব দৈনন্দিন কাজই খুব মন্তরগতি হয়ে যায়। এরোগে প্রবীণদের বেশি আক্রান্ত হওয়ার আশংকা থাকে।
প্রতিকারঃ একটা বয়সে পৌছালে হাড়ের ক্ষয় হতে শুরু করে। ৭৫-৮০ বয়সে হাড়ের ক্ষয় সর্বাধিক হয়। ছেলেদের ক্ষেত্রে হাড়ের ক্ষয় শুরু হয় ৬৫ বছরের পর থেকে আর মেয়েরদের ক্ষেত্রে ৪৫ উদ্ধ অর্থাৎ রজঃস্রাব বন্ধ হয়ে গেলে শুরু হয় হাড়ের ক্ষয়।তাই ৪০-৪৫ বছর বয়স থেকেই নিয়মিত হাড়ের ঘনত্বের পরীক্ষা করা দরকার। এই পরীক্ষাকে বলা হয় বি এম ডি বা বোন মিনারেল ডেনসিটি মাপক পরীক্ষা। এই পরীক্ষা দিয়ে বোঝা যায় হাড়ের ঘনত্বটা কেমন আছে। যাদের খুব কম ঘনত্ব অর্থাৎ ২.৫ বা তার বেশি তাদের ক্ষেত্রে হাড় খুব সহজেই ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যাদের ঘনত্‌ব ১.৫ তারা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আর যাদের ঘনত্ব০। তাদের অবস্থা ভালো। তাই এই সময়ে যাদের হাড়ের ঘনত্ব খুব কম তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি নিয়মিত খাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়া বয়স বেশি হলে হাঁটা চলার সময় সতর্কতা, দরকার পড়লে লাঠি নিয়ে হাঁটা। উচু নিচু জায়গা এড়িয়ে চলা, পিচ্ছিল জায়গায় সতর্ক হয়ে হাটা‌, বাথরুম সবসময় শুকনো রাখা দরকার বেশি ভিজে বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়ে কোমরের কিংবা হাটুর হাড় ভেঙ্গে যেতে পারে। এ সময় সিড়ি দিয়ে উঠানামা করার সময়ে তাড়াহুড়ো না করে ধীরে ধীরে পা ফেলতে হবে। বয়স হয়ে গেলে হাটা চলায় একটু কুড়েমি আসে। এটা ঠিক নয়। প্রতিদিন নিয়মিত হাটাটা খুবই দরকার।
এসময়ে চোখে ছানি পড়ে, দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে যায়। তাই হাঁটাচলার সময়ে উঁচুনিচু অবস্থান বুঝতে না পেরে অনেক বয়স্ক-বয়স্করা পড়ে চোট পেতে পারেন। তাই চোখে চিকিৎসকের পরামর্শমত চশমা পরাটা খুবই দরকার।
ছানি পেকে গেলে অপারেশন করে নিলে ভালো হয়।
বৃদ্ধ বয়সে উচ্চরক্তচাপ, মধুমেহ রোগ বেশি দেখা দেয়। তাই এসব রোগকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ খেয়ে রোগটা নিয়ন্ত্রণে রাখাটা দরকার। কেননা এসব রোগের জটিলতায়- হৃদরোগ, কিডনি ফেলিওর, ব্রেন স্ট্রোক, হঠাৎ করে অন্ধত্ব, পায়ে গ্যাংরিন দেখা দিয়ে মৃত্যু ঘটাতে পারে। এবয়সে অনেক সময়ে রোগের লক্ষণ চেপে যাওয়ার প্রবণতা থাকে বিশেষ করে চিকিৎসকের কাছে। এতে করে রোগ সণাক্তকরণে ভুল হয়ে ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় উল্টো বিপত্তি দেখা দিতে পারে। তাই এধরণের মানসিকতা সম্পূর্ণ ভাবে বর্জনীয়।
অনিদ্রা এই বয়সে একটা বড় সমস্যা। এই সমস্যা প্রতিকারের জন্য বেশি রাত জেগে টিভি দেখা, সিনেমা দেখা থেকে বিরত থাকতে হবে। বেশি রাত করে শোওয়া চলবে না। ৯-১০ টার মধ্যে বিছানায় চলে যাওয়া উচিত। শোওয়ার ঘর অন্ধকার না রেখে হালকা নাইট ব্লাব জ্বালিয়ে পড়া ভাল। শোওয়ার আগে একটু জপতপ করে নিলে ঘুম ভালো হয়। ঘুমের ওষুধ এড়িয়ে চলতে পারলে খুবই ভাল হয়। কেননা বেশির ভাগ ঘুমের ওষুধে হ্যাংকওভার থাকে বলে পরদিন সকালে ঢুলুঢুলু ভাব থাকে। শুধু তাই নয় রাতে বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হলে ঘুম চোখে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এসময় শ্রবণ ইন্দ্রিয় দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে কানে কম শোনে। তাই রাস্তা পারাপার করার সময়ে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার।
এছাড়া এসময় স্নায়ু তন্ত্র শিথিল হয়ে পড়ায় রিফ্লেক্ট অ্যাকশন কমে যায়। তার ফলে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে এইসময়।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পড়ে কিছুক্ষণ ধ্যান, প্রাণয়ান, যোগ-ব্যায়াম, হার্টের অসুখ না থাকলে আধঘন্টা হাঁটা চলা করা দরকার।
গরমকালে ভোরে ও শীতের দিনে কুয়াশা সরে যাওয়ার পরে প্রাতঃভ্রমণ বা হাস্যযোগ যোগ দিলে ভাল লাগবে।  জলসখাবার ও চা পানের পরে, প্রত্যেকদিন কিছু কাজকর্ম করা দরকার। দুপুরে পেট ভরে না খাওয়াই ভালো। সহজপাচ্য খাবার, শাকসবজি, ফল, মাছ, টক দই খাওয়া যেতে পারে। পরে একটু১/২ ঘন্টার জন্যে দিবানিদ্রা দেওয়া যেতে পারে। এতে শরীর সুস্থ রাখার ক্ষেত্রে কার্যকরী। বিকেলে একটু ভাল খাওয়া খেতে পারে। সন্ধ্যায় চা ও বিস্কুট খেতে কোন আপত্তি নেই। তবে ডায়াবেটিস রোগীর চায়ে চিনি না খাওয়াই ভাল। বিকেলে একটা হাঁটাচলা করা ও সমবয়সীদের সঙ্গে গল্প, আড্ডায় মজলে দেহ ও মনের পক্ষে উপকারী। সন্ধ্যাবেলা একা না থেকে কারো সাথে আড্ডা, আলোচনা চলতে পারে। তবে নেগেটিভ চিন্তা ভাবনা না করাই ভাল। নিজেকে অকর্ম্য, দুর্বল, রোগাগ্রস্থ না ভাবাটা উচিত।  রাতে আহারের পরে কিছু পায়চারি করে ঘুমলে ঘুম আসতে দেরি হয় না। যাদের হৃদরোগ , উচ্চরক্তচাপ কংবা মধুমেহ রোগ আছে অথবা মানসিক অসুখে আক্রান্ত তাঁরা দিন রাত মিলিয়ে যে সমস্ত ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ চিকিৎসকেরা দিয়েছেন সেটা খেতে ভুললে চলবে না। মনে রাখতে হবে রাতের পর দিন আসে। দিনের পরে রাত। এই নিয়ে বার্ধক্যে আনন্দময় দিনযাপন অতিবাহিত করা।
খাবারে নিয়মিত ফল, শাকসবজি ও দুধ রাখতে হবে। গুরুপাক খাওয়া চলবে না। কেননা এসময় পৌষ্টিক নালীর পাচন করার ক্ষমতা কমে যায়। সহজপাচ্য খাবারই ভালো দেহের সুস্থতার পক্ষে।  ওসিউর রহমান, ৭৯৮০১৫৫২৭৭

1 comment:

  1. Nice post. I was checking constantly this blog and I am impressed! Extremely helpful information specially the last part I care for such info a lot. I was seeking this particular information for a very long time. Thank you and good luck.
    tornado cash

    ReplyDelete